সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি ও একটি মেডিকেল মিরাকল
বেগম খালেদা জিয়ার সেনাকুঞ্জ সফরের অনেক ভিডিও দেখলাম গতকাল! আমি যেহেতু চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র – আমি ওনার ভিডিও গুলো দেখেছি অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে! প্রথমত কাল দেখলাম, তিনি হাসছেন এবং শ্বাস নেয়ার জন্য না থেমে এবং না হাপিয়ে গিয়ে মোটামুটি লম্বা সময় কথা বলতে পারছেন। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করলাম ওনার অক্সিজেন লাগছে না!
এই পুরো ব্যাপারটা একটা মিরাকল ছাড়া আর কিছু না। এই কিছুদিন আগে ৮০ বছর বয়সি ৬-৭ মাস টানা আইসিইউ তে কাটালেন। ওনার কিডনি ফেইল করেছিল; হার্ট ফেইলিউর ছিল; লিভার পুরো ফেইল করেছে। লিভার ফেইলিউর এর জীবনঘাতী কমপ্লিকেশন যা যা হতে পারে সব ই তাঁর ছিল – সারা শরীরে পানি, পায়ে পানি, পেটে পানি, ফুসফুসে পানি! প্রতিদিন পেট আর ফুসফুস এর পাশ থেকে সুঁই ঢুকিয়ে লিটার কে লিটার পানি ড্রেইন করতে হতো।
ওনার দুই চেষ্টা এই চেষ্টা টিউব ঢোকানো ছিল কন্টিনিউয়াস পানি ড্রেইন করানোর জন্য। ঘাড়ের মধ্যে বিশাল মোটা ডায়ালাইসিস লাইন ছিল। আরো কিছু কঠিন সমস্যা ছিল যেমন রিউমাটয়েড আর্থরাইটিস তার কথায় পরে আসছি…
পৃথিবীর সবচেয়ে এডভান্সড আইসিইউ গুলোতে আমি কাজ করছি গত ২০ বছর ধরে। আশি বছর বয়সি একজন মানুষ এডভান্সড রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস যার লিভার ফেইল করেছে – কিডনি ফেইল করেছে; সিভিয়ার পালমোনারি হাইপারটেনশন আছে, এইদেশে আমরা আশা ছেড়ে দিতাম! বলে দিতাম প্যালিয়েটিভ কেয়ার নাও – হসপিসে চলে যাও!
৮০ বছর বয়সি একজন মানুষের লিভার ফেইলিউর একটা ওয়ানওয়ে জার্নি। বাকি সব অর্গান ডোমিনোর মতো ফেইল করা শুরু করে। রোগী বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।
মিসেস খালেদা জিয়া যে সাত মাস আইসিইউ থেকে কাল সেনা কুঞ্জে এসে সবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন, আবারো বলছি এটা মেডিকেল মিরাকল। উপরিওয়ালা কোথাও কেউ নিশ্চয় আছেন; যিনি সম্ভব – অসম্ভবের কারিগর, উনিই হয়ত চেয়েছেন অসম্ভবের ঘড়ির কাটা টাকে হাত দিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে। কেউ ওনাকে এই দিনটা দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন! কারও কোনো পুণ্য আছে কোথাও এই সম্ভব-অসম্ভবের উল্টোচালে।
আপনারা কেউ কি ওনার হাত দুটো খেয়াল করেছেন? কি ভাবে বেঁকে গিয়েছে? কনট্রাক্টেড হয়ে গিয়েছে? আমরা মেডিকেল কলেজে পড়েছি সোয়ান নেক ডিফর্মিটি; বাটোনেআর ডিফর্মিটি। গত শতাব্দীর টার্ম! এই শতাব্দীর মেডিকেল স্টুডেন্টরা এগুলো খুব একটা দেখে না এখন। রিউমাটয়েড আর্থরাইটিস এর চিকিৎসা না হলে বার্ন্ট আউট হয়ে যায়। এডভান্সড রিউমাটোয়েড আর্থরাইটিস এর শেষ পর্যায়ে গিয়ে হাতগুলো এভাবে শক্ত হয়ে কুঁকড়ে যায়। দুটো হাতই শুধু অচল হয় না – অবর্ণনীয় যন্ত্রণা হয় হাই ডোজ ইম্মিউনিটি সাপ্রেস করা মেডিসিন এ না থাকলে।
আপনি কি খেয়াল করেছেন উনি পা লম্বা করে হুইল চেয়ারে বসে ছিলেন? উনি পা ভাঁজ করতে পারেন না! ওনাকে স্ট্র্যাপ দিয়ে হুইল চেয়ার এর সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল। যাতে পরে না যান। আমি খেয়াল করছিলাম ওনার ছোট পুত্রবধূ প্রতিটা মুহূর্ত শ্বাশুড়ির দিকে চোখ রাখছেন – কখন কি হয়ে যায়!
একটা জীবন চিন্তা করুন তো? অবর্ণনীয় ব্যথার কারণে পা ভাঁজ করা যায় না, স্টিফ হয়ে গিয়েছে। হাত দুটো অচল! পুরো পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে ওনাকে! হ্যাঁ আমি বলছি “দেয়া হয়েছে” –
এমনি এমনি হয় নি!
আগে ওনাকে যখন টিভি তে দেখেছি তখন তো এতো খারাপ অবস্থা ছিল না। উনি এই হাত দিয়ে করমর্দন করতেন, সারাদিন ফাইল স্বাক্ষর করতেন! একটু খুঁড়িয়ে হলেও হাঁটতে পারতেন। ২০০৮ এর নির্বাচনের আগে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৯ ঘণ্টা ক্যাম্পেইন করেছেন, সারারাত পথসভা করেছেন।
আজকাল আমরা এই ধরনের রিউমাটয়েড ডিফর্মিটি খুব কম দেখি। কারণ আজকাল রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস এর অনেক ডিজিজ মোডিফাইয়িং ঔষধ আছে। এই ঔষধ টা কন্ট্রোল করে রাখা যায়! একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান রিউমাটয়েড আর্থ্রাটিস কি এখন আর ওই পর্যায়ে পৌঁছতে দেয় না।
কিন্তু উনি যেই চার পাঁচ বছর জেলে ছিলেন তখন তাঁর উপর গরুর চিকিৎসা হয়েছে। মানুষের চিকিৎসা হয়নি। উনি আধুনিক কোন চিকিৎসা পান নি! যেই ঔষধ দেয়া হয়েছে তাতে ওনার ডিজিজ কন্ট্রোল তো হয়ই নি – লিভার, কিডনি ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে।
২০০৭ এর পর থেকে ওনার পরিবারের উপর যা গিয়েছে তা ট্র্যাজিক মহাকাব্য। বড় ছেলেকে মেরে তার কোমর ভেঙে দেয়া হয়েছিল। তার দশ বছর লেগেছে স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে! আরেক ছেলের উপর (যে রাজনীতির র এর সাথে জড়িত ছিল না) তার উপর কি ঝড় গিয়েছে আল্লাহই জানে। ছাড়া পাবার কিছুদিন পর ৪৫ বছরের সুষ্ঠু তরুণ ক্রিকেট প্লেয়ার মানুষ টা ধুম করে মরে গেলেন।
এই কাজগুলো যারা করেছেন, যাদের সিদ্ধান্তে হয়েছে, যারা এক্জিকিউট করছেন – তাদেরকে জিয়া পরিবার ক্ষমা করলেও এই দেশের একটা বিশাল অংশ মানুষ কোনোদিনই ক্ষমা করবে না!
আরেকটা কথা – মিসেস খালেদা জিয়ার এখন কি উচ্চ চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া উচিত? আমার মতে এখন এটা পলিটিক্যাল ও পারিবারিক ডিসিশন; মেডিকেল ডিসিশন না। ওনার যে মেডিকেল টিম তাদের অনেককে আমি চিনি! ওঁদের উপর আমার ১০০% আস্থা আছে। আমি মনে করি উনারাই যথেষ্ট। ওনাকে টেনে হিঁচড়ে বিদেশে নেবার কোন যুক্তি বা মেডিকেল নেসিসিটি আমি দেখি না। এটা আমার ব্যক্তিগত মত। ওনার পরিবার আরো ভালো বুঝবেন।
আশা করি মিসেস জিয়া দীর্ঘজীবী হোন! আরো অনেক দিন বেঁচে থাকুন। এবং টানা হেঁচড়া ধাক্কা ধাক্কি ছাড়া নিজের বাড়িতে একটু শান্তিতে থাকুন। She served her nation with the last bit of her strength. She has done her duty. And she has done that darn well. Let her rest now!
(লেখাটি ফেসবুক থেকে নেওয়া)
রুমি আহমেদ: অধ্যাপক, ডেল মেডিকেল স্কুল, ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অস্টিন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত