পাঠ্যপুস্তুক থেকে আওয়ামী বয়ান বাতিল করার দাবি ইউট্যাবের
পাঠ্যপুস্তক থেকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী কথাগুলো বাতিল করে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব)।
শনিবার (২৫ জানুয়ারি) ইউট্যাবের এক পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়।
সংগঠনটি মনে করে, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রকাশিত ও সরবরাহকৃত পাঠ্যপুস্তকগুলোতে এখনো ফ্যাসিস্ট আওয়ামী বয়ান ও ইতিহাস বিকৃতি বহাল রাখা হয়েছে।
সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম ও মহাসচিব অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান এ বিবৃতিতে বলেন, আমরা মনে করি, বাংলাদেশে গণহত্যাকারী ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের হাতে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক বয়ান অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। সেই সঙ্গে চব্বিশের ছাত্র-নাগরিক গণঅভ্যুত্থানের পরও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের যে বা যারা পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের নামে আওয়ামী বয়ানকে প্রচারে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নিতে হবে।
তারা বলেন, ইতোমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, নবম-দশম শ্রেণীর ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা’ বইয়ের ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন ব্যবস্থা’ শীর্ষক সপ্তম অধ্যায়ে গণহত্যাকারী ও বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধ্বংসকারী আওয়ামী লীগকে দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম দল হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। বইটির একই অধ্যায়ে বিএনপি সম্পর্কেও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া হয়েছে। জিয়াউর রহমানকে সাবেক রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে সাবেক সেনাপ্রধান উল্লেখ করে জিয়াউর রহমানের শাসনামলকে সামরিক শাসনামল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিতর্কের মুখে অনলাইন ভার্সনে এই বিষয়ে পরিবর্তন আনা হলেও অনেক মুদ্রিত বইয়ে আওয়ামী বয়ান বহাল রয়ে গেছে।
তারা উল্লেখ করেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া ও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান সম্পৃক্ত অল্প বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। তবে নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলা সাহিত্য’ বইয়ে ‘আমাদের নতুন গৌরবগাঁথা’ অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে ‘পতন অত্যাসন্ন টের পেয়ে স্বৈরাচারী সরকার প্রধান পালিয়ে যান দেশ ছেড়ে। অভাবনীয় এক গণঅভ্যুত্থান দেখে সারা দুনিয়ার মানুষ।’ এখানে শেখ হাসিনা কিংবা তার দল আওয়ামী লীগের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
তারা আরও বলেন, নবম-দশম শ্রেণীর ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্ব সভ্যতা’ বইয়ের ‘সত্তরের নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক ত্রয়োদশ অধ্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারসহ নানা বিষয়ে আওয়ামী লীগকে নানাভাবে গ্লোরিফাই করা হয়েছে। একই পাঠ্যবইয়ের ‘প্রাচীন বাংলার ইতিহাস’ শীর্ষক চতুর্থ অধ্যায়ে বখতিয়ার খিলজিকে একজন ভাগ্যন্বেষী যোদ্ধা বলে উল্লেখ করে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তৃতীয় থেকে নবম-দশম শ্রেণীর ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা হলেও শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের বিশাল ছবিসহ উপস্থাপন করে প্রকারান্তরে আওয়ামী বয়ানকে সুক্ষ্মভাবে গ্লোরিফাই করার চেষ্টা করা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইয়ে ‘আমাদের চার নেতা’ নামে নতুন একটি অধ্যায় যুক্ত করে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই তবে এই অধ্যায়ে স্বাধীনতার ঘোষক এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সংক্ষিপ্ত বিবরণও অর্ন্তভূক্ত করা যেত।
শিক্ষক সমাজের এই দুই নেতা আরও বলেন, আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি, পূর্ব থেকে সমাধানকৃত উপজাতি-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী-আদিবাসী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত থাকার পরও নবম ও দশম শ্রেণীর ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত একটি গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছিল। যার ফলে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং তার পুরো দায়ভার জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড- এনসিটিবি সংশ্লিষ্টদের।
সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণ শেষে তাদের মনে করছেন, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে রাজনৈতিক ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, বিএনপি সম্পর্কে তথ্য যথাযথভাবে পরিবেশিত হয়নি। একইসাথে ২০২৪ সালের ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থানের প্রকৃত ইতিহাসও যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। অপরদিকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বাকশালের ইতিহাস, গণতন্ত্র ধ্বংসের ইতিহাস, গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরার পরিবর্তে সুক্ষ্মভাবে আওয়ামী বয়ানকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ইউট্যাবের প্রেডিসডেন্ট ও মহাসচিব বলেন, জানুয়ারি মাস প্রায় শেষ হয়ে আসলেও এখনো অনেক শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। আগামী মার্চ কিংবা এপ্রিলেও শিক্ষার্থীরা সব বই হাতে পাবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গণমাধ্যমের খবর মতে, এই ব্যর্থতার পেছনে এনসিটিবির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ একটি শক্তিশালী চক্র জড়িত রয়েছে। সরকারকে বিব্রত করতে এবং কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সরকারের বিরুদ্ধে মুখোমুখি করাতে তারা এই অপচেষ্টা চালিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, রাজনৈতিক ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, বিএনপি, ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থান পাঠ্যপুস্তকে যথাযথভাবে উপস্থাপনে অবিলম্বে উদ্যোগ নিতে হবে। সুক্ষ্মভাবে আওয়ামী যেসব বয়ানকে উপস্থাপন করা হয়েছে তা বাতিল করে আওয়ামী লীগের বাকশালের ইতিহাস, গণতন্ত্র ধ্বংসের ইতিহাস, গণহত্যার ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে তুলে ধরতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
তারা বলেন, পাঠ্যপুস্তকে আওয়ামী বয়ান সন্নিবেশন করে ইতিহাসকে বিকৃত করার সাথে জড়িত এবং বিগত দেড় দশক ধরে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের পক্ষে ভূমিকা পালনকারী জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এ কর্মরত দোসরদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। একইসাথে পাঠ্যপুস্তক বিতরণে ব্যর্থতার সাথে ও দুর্নীতির সাথে জড়িত এনসিটিবি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত