এবার ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্তি বাতিল ও স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে দ্বিতীয় দফায় তিন ঘণ্টার অবরোধের পর ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে রাজপথ ছেড়েছেন রাজধানীর সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। দাবি না মানলে সামনে কঠিন অবস্থান কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেন তারা।
বুধবার (২৩ অক্টোবর) বিকাল ৩টায় ঢাকা কলেজের মূল ফটকের সামনে থেকে ৭২ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরের সমন্বয়ক ও ঢাকা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুর রহমান।
শিক্ষার্থী আবদুর রহমান বলেন, এবার আামদের এক দফা দাবি সাত কলেজকে স্বতন্ত্র বা স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আমরা সরকারকে শনিবার পর্যন্ত সময় দিলাম। আমাদের দাবি না মানলে নতুন কর্মসূচি প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, সাত কলেজ যদি সুষ্ঠু সমাধান পায় তাহলে ঢাকা শহর ভালো থাকবে। আমাদের দাবি না মানলে কঠিন কর্মসূচিতে যাবো, যা কেউ কল্পনা করতে পারবে না। সাত কলেজের একমাত্র সমাধান স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় করা। গত সাত বছরে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। সাত কলেজ নিয়ে আর ব্যবসা চলবে না। সব সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে।
এদিন দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা কলেজের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাত কলেজের এক হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। পরে মিছিলটি কলেজ প্রদক্ষিণ করে মিরপুর রোড হয়ে সাইন্সল্যাবে অবস্থান নেন। এরপর মিছিলটি নীলক্ষেত হয়ে ঢাকা কলেজের মূল ফটকের সামনে সমাপ্ত হয়। তিন ঘন্টা রাস্তা অবরোধের কারণে মিরপুর সড়ক ও এলিফ্যান্ট রোডে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। আন্দোলন শেষে যানচলাচল স্বাভাবিক হয়।
এ সময় শিক্ষার্থীরা- ‘অধিভুক্তি নাকি মুক্তি? মুক্তি মুক্তি’; ‘শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য, মানি না মানব না’; ‘আর নয় দাসত্ব, হতে চাই স্বতন্ত্র’; ‘ঢাবির জায়গায় ঢাবি থাক, সাত কলেজ মুক্তি পাক’; ‘নিপীড়ন না কি অধিকার? অধিকার অধিকার’; ‘প্রশাসনের প্রহসন, মানি না মানব না’; ‘টু জিরো টু ফোর, অ্যাফিলিয়েশন নো মোর’; ‘আমার পরিচয় দিতে হবে, পড়ার টেবিলে যেতে হবে’; ‘স্বাধীনভাবে বলতে চাই, আমার অধিকার ফেরত চাই’- ইত্যাদি স্লোগান দেন।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা বলেন, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাত কলেজকে অপরিকল্পিতভাবে ঢাবির অধিভুক্ত করলেও শিক্ষার মানের কোনো উন্নয়ন হয়নি, উল্টো শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বেড়েছে। বর্তমানে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা পরিচয়হীনতায় ভুগছে।
এ ছাড়া রয়েছে ক্লাসরুম সংকট, সিলেবাস শেষ না করেই পরীক্ষা নেওয়া, ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব, ভর্তি কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা, ল্যাবসংকট, লাইব্রেরির অপ্রতুলতা, হুটহাট পরীক্ষা শুরু করা, সহশিক্ষা কার্যক্রম (বিতর্ক, আবৃত্তি, বিএনসিসি, রোভার স্কাউটিং, রেট ক্রিসেন্ট) সেভাবে বরাদ্দ নেই, মাত্রাতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি, সার্টিফিকেটে অ্যাফিলিয়েশন শব্দ, সেমিস্টার সিস্টেম নেই, বাংলা মাধ্যমে পড়ানো, মানোন্নয়ন ফি দিতে সাত কলেজে লাগে ২ হাজার টাকার বেশি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগে মাত্র ৫০০ বা ৭০০ টাকা, কলেজ প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, অনলাইন সমাবর্তন, রেজাল্ট সমন্বয়ে গড়িমসি, সাবজেক্ট চয়েসে মাইগ্রেশন সিস্টেমে সমস্যা, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ইমপ্রুভমেন্ট ফি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের ফি অস্বাভাবিক হারে বাড়ানোসহ ইত্যাদি সমস্যা।
প্রাথমিকভাবে এই আন্দোলনে তিন দফা দাবি নিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। তাদের দাবিগুলো হচ্ছে- সাত কলেজ নিয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করার অভিপ্রায়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি সংস্কার কমিটি গঠন করতে হবে, সংস্কার কমিটি অনধিক ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সাত কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সাত কলেজের সমন্বয়ে শুধু একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার রূপরেখা প্রণয়ন করবেন ও সংস্কার কমিটি বর্তমান কাঠামো সচল রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবেন, যাতে করে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সেশন জটিলতার কোনো ধরনের পরিবেশ তৈরি না হয়।
সাত কলেজ সংস্কারের প্রতিনিধি ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী সাবরিনা সুলতানা কালবেলাকে বলেন, আমরা সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বৈষম্যের স্বীকার হয়েছি। এ সকল বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে সাত কলেজকে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি করেছি। শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ঢাবির অধিভুক্ত করলেও সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নে সাত কলেজে ভর্তি হলেও এখানে এসে তাদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। আমরা অন্তবর্তী সরকারকে যে স্মারকলিপি দিয়েছি সেই অনুযায়ী দ্রুত সময়ে একটি কমিশন গঠন করা হোক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রূপরেখা দেওয়া হোক।
সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরের সমন্বয়ক ও কবি নজরুল ইসলাম কলেজের শিক্ষার্থী জাকারিয়া বারি সাগর বলেন, আমরা সাত কলেজের সমন্বয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত বা স্বতন্ত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি করছি। এ দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে আমরা শিক্ষা উপদেষ্টা, বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কারও থেকেই কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি।
তিনি আরও বলেন, স্বতন্ত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আমরা সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ২১ অক্টোবর মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছি। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় আমরা পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে তিন দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছি।
নিউমার্কেট থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) মোহসীন উদ্দীন কালবেলাকে বলেন, শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠুভাবে আন্দোলন করেছে। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেনি।
এর আগে গত সোমবার (২১ অক্টোবর) বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে তিন দাবিতে রাজধানীর সাইন্সল্যাব ও নীলক্ষেত মোড়ে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। চার ঘণ্টা অবস্থান কর্মসূচির পর বিকেলে সাইন্সল্যাব থেকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটামের ঘোষণা দেন সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর আন্দোলনের সমন্বয়ক আবদুর রহমান।
এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা কলেজে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা সাত কলেজের সমস্যার চিত্র তুলে ধরেন। নানা সমস্যা তুলে ধরতে আয়োজিত প্রথম এ সংবাদ সম্মেলনেই স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার দাবি জানানো হয়। এরপর একই দাবি জানিয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান ও ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজকে স্মারকলিপি দেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সমাধান না পেয়ে রাস্তায় নামার সিদ্ধান্ত নেন তারা।
ঢাবি অধিভুক্ত কলেজগুলো হলো, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ এবং সরকারি তিতুমীর কলেজ।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত