কারবালা প্রান্তর এখন আধুনিক শহর
ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে যা ঘটেছিল, তা এক কথায় নির্মম, নিষ্ঠুর ও হৃদয়বিদারক। মহররম মাসের ১০ তারিখে এ ময়দানে সপরিবারে হত্যা করা হয় নবীদৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-কে। দুপুরের তপ্ত রোদে পানির পিপাসায় আটকে রেখে তীরবিদ্ধ করা হয় গলায়, তারপর আহত ইমামকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় পরিবারের নারী-শিশুদের চোখের সামনে। এ ঘটনা শুনলে অন্তর কেঁপে ওঠে যে কোনো মানুষের। মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের মর্মান্তিক ঘটনা শুনলে চোখ দিয়ে পানি ঝরাবে না এমন কেউ নেই। সেদিন হজরত হোসাইন (রা.) উত্তপ্ত মরুভূমিকে বানিয়েছিলেন ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি। তাতে তিনি নিজ শরীরের রক্তকে কালি বানিয়ে রচনা করেছেন শোকের ইতিহাস। কারবালা প্রান্তরের হৃদয়বিদারক সেই ঘটনা আজও মানুষকে শোকাবহ ও বেদনার্ত করে।
সেই কারবালা এখন কেমনÑপৃথিবীর মুসলমানসহ যে কোনো মানুষের কাছেই এটি কৌতূহলের বিষয়। হিজরি ৬১ সালে কারবালা ছিল ইরাকের ফোরাতের নদীর তীরবর্তী একটি জনশূন্য প্রান্তর। তিন পাশে মরুভূমি, পাহাড়, টিলা এবং একপাশে ফোরাত নদীর বহমান জলধারা। তবে কালের আবর্তে সেই কারবালা প্রান্তর আর ফাঁকা নেই। সেখানে গড়ে উঠেছে আধুনিক তিলোত্তমা শহর, রোডঘাট, মার্কেট, শপিং মল, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, আবাসিক এলাকাসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধার একটি জনপদ। কারবালা বর্তমান ইরাকের মধ্যবর্তী একটি শহর। রাজধানী বাগদাদ থেকে ১০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে কারবালার অবস্থান। বাগদাদ থেকে ট্রেনে করে কারবালা যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কারবালার উচ্চতা ৩০ মিটার উঁচুতে। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কারবালা প্রদেশের মোট জনসংখ্যা ৭০ লাখ। এ শহরে ইমাম হোসাইন (রা.) ও আব্বাস ইবনে আলির কবর রয়েছে। প্রাচীনকালে এ শহরের নাম ছিল কোর-বাবিল। কারণ, প্রাচীন ব্যাবিলনীয় কিছু গ্রামের সমষ্টিগত নাম ছিল এটি। তখনকার বাবিল শহরের কথা আল্লাহতায়ালা প্রসঙ্গক্রমে পবিত্র কোরআনেও উল্লেখ করেছেন। কিছু ঐতিহাসিক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, কারবালা নামটি এসেছে আরবি ‘কারব’ (অর্থাৎ বিপদ-যন্ত্রণা) ও ‘বালা’ (অর্থাৎ বিয়োগান্ত-দুর্বিপাক) শব্দ থেকে এসেছে। এখানকার জমিনে ৬১ হিজরিতে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের মর্মন্তুদ ও শোকাবহ ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। ২০০৩ সালে মার্কিন যুদ্ধের কারণে ইরাকে প্রভাব ফেললেও কারবালায় কিছুটা কম পড়েছে। ফলে কারবালা শহরটি বেশ সাজানো-গোছানো ও পরিপাটি। কারবালার লোকজনও অনেক সচেতন। যত্রতত্র তারা ময়লা-আবর্জনা ফেলে না। শহরকে দৃষ্টিনন্দন ও মনোমুগ্ধকর করে রাখতে তারা যথেষ্ট সতর্ক থাকে।
বিভিন্ন দেশ ও শহর থেকে আসা [ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কবর জিয়ারত করতে] লোক ও পথচারীর জন্য পথেঘাটে পানীয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থস্বল্প লোকদের বিনামূল্যে কারবালায় যাতায়াতের জন্য মিনিবাস, অটোগাড়িসহ অন্যান্য যানবাহনের ব্যবস্থা রয়েছে। গাধার গাড়ি এখানকার জনপ্রিয় যাত্রাবাহন। কারবালার রাস্তায় উটও দেখা মেলে অনেক। সাতসকালে বিভিন্ন যানবাহনে করে দূর-দূরান্ত থেকে নারী-পুরুষ কারবালায় খাদ্যসামগ্রী বিক্রি করতে আসে। সন্ধ্যারাত থেকে কারবালার মসজিদগুলোর পার্শ্ববর্তী ফুলবাগানগুলোয় আলোকবর্তিকা জ্বলে ওঠে। বিভিন্ন রঙের আলোর পসরা উজ্জ্বলতা ছড়ায় আশপাশে। তখন মসজিদগুলোর আঙিনা নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে। নামাজের আগে স্থানীয় লোকজন এসে সন্ধ্যাকালীন আড্ডায় মেতে ওঠে।
ইরাকে বসন্তকাল দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় কারবালা বছরের অনেকটা সময় ফুলে-পুষ্পে সুশোভিত থাকে। বাড়িঘরের আঙিনার গাছগুলো অনেক দিন ফুলে ছেয়ে থাকে। মাঠ-ময়দান সবুজাভ হয়ে থাকে। অন্যদিকে শহরের বাইরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে সারি সারি খেজুরবীথি রয়েছে। বাগানে উৎপন্ন খেজুরগুলো দেশের বিভিন্ন শহরের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দুয়েকটা দেশেও রপ্তানি করা হয়। অবশ্য আরব দেশ হিসেবে কারবালায় মরু-অঞ্চলও রয়েছে। রয়েছে সারি সারি বালুর ঢিবি। তবে সবকিছু মিলিয়ে কারবালা অনেক সুন্দর ও মনোরম শহর। ইমাম হোসাইন (রা.) এর কবর, তিল্লে জায়নাবিয়া, হজরত আব্বাস ইবনে আলির কবর, বিখ্যাত ফোরাত নদী ইত্যাদি কারবালার রূপ-সৌকর্যে কনকশোভা যোগ করেছে। এ ছাড়া ভাস্কর্য, পার্ক, শপিং মল, রেস্তোরাঁ এবং বাহারি ফুলের বাগানে সমৃদ্ধ কারবালা এখন আধুনিক ও মনোরম একটি শহর।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত