কুমিল্লায় ৩ খুনের নেতৃত্বে ছিলেন চেয়ারম্যান-মেম্বার
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহ ও বাচ্চু মেম্বারের নেতৃত্বে লোকজন বাড়ি ঘেরাও করে। এরপর নির্মমভাবে পেটানো হয় মা রোকসনা আক্তার রুবিকে (৫৫) । মাকে বাঁচাতে এসেছিলেন মেয়ে তাসফিয়া আক্তার জোনাকি (২৯), রুমা আক্তার (২৬) ও ছেলে রাসেল মিয়া (২৮)।
তাদেরও নির্মমভাবে পেটানো হয়। তারা লুটিয়ে পড়লেও মন গলেনি হামলাকারীদের। একপর্যায়ে লোকজন তাদের এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এতে মৃত্যু হয় মা ও দুই সন্তানের। আরেক সন্তান রুমা হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) কুমিল্লার মুরাদনগরের আকুবপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামে মব সৃষ্টি করে তিনজনকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় উঠে এসেছে নৃশংসতার তথ্য।
পরে শুক্রবার (৪ জুলাই) রাতে নিহত রুবির আরেক মেয়ে রিক্তা আক্তার বাদী হয়ে বাঙ্গরা বাজার থানায় এ মামলা করেন। এতে ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০ থেকে ২৬ জনকে আসামি করা হয়।
চাঞ্চল্যকর ওই ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়েছে। এর মধ্যে শনিবার (৫ জুলাই) ভোরে এজাহারভুক্ত বাবুল মিয়া (৫০) ও ছবির মিয়াকে (৪৫) গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। তাদের থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। পাশাপাশি র্যাব সদস্যরা ঢাকায় আত্মগোপনে থাকা আরও ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেন।
বাঙ্গরা বাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।’ এদিকে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে কড়ইবাড়ি গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন জানায়, মুরাদনগর-নবীনগর সড়কের কড়ইবাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রুবির বাড়ির পাশে একটি ওষুধের দোকান থেকে স্থানীয় এক শিক্ষকের মোবাইল ফোন চুরি হয়। অভিযোগ ওঠে, বোরহান উদ্দিন ওরফে মারুফ নামের এক তরুণ ওই ফোনটি চুরি করেছে। ওই তরুণ রুবির মেয়ে জোনাকির স্বামী মনির হোসেনের সঙ্গে মাদকের কারবার করে। মোবাইল ফোন চুরির ঘটনায় মঙ্গলবার স্থানীয় আকুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার বাচ্চু মিয়া ও স্থানীয় বাছির উদ্দিনের নেতৃত্ব মারুফকে মারধর করা হয়।
পরে খবর পেয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিতে যান রুবি। সেখানে বাচ্চু-বাছিরসহ অন্যদের সঙ্গে রুবি ও তার পক্ষের লোকজনের বাগবিতণ্ডা ও একপর্যায়ে হাতাহাতি হয়। ওই ঘটনাকে ঘিরে পরদিন বুধবারও দুপক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এসব নিয়ে দুপক্ষে উত্তেজনা চলছিল।
এর জের ধরে বৃহস্পতিবার সকালে কড়ইবাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রুবির বাড়িতে লোকজন নিয়ে যান স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল ও ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া। তখনো তাদের সঙ্গে রুবি ও তার মেয়েদের বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে চেয়ারম্যান ও মেম্বারের লোকজন মিলে হামলা শুরু করে। ঘটনাস্থলেই রুবি তার ছেলে রাসেল ও মেয়ে জোনাকির মৃত্যু হয়।
শুক্রবার বিকেলে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে তিনজনের মরদেহ বুঝে নেন নিহত জোনাকি আক্তারের স্বামী মনির হোসেন। ওইদিন সন্ধ্যায় গ্রাম পুলিশের সহায়তায় তিনটি কবর খোঁড়া হয়। গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়ায় জানাজায়ও ইমামসহ ৮ থেকে ৯ জন উপস্থিত ছিলেন। পরে রাতেই দাফন শেষ হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক আবু তাহের ভূঁইয়া কালবেলাকে বলেন, ‘সুরতহাল প্রতিবেদনে রোকসানা আক্তার রুবি ও ছেলে রাসেলের মাথা বেশি থেঁতলানো ছিল। মেয়ে রুমা আক্তারসহ তিনজনের মাথা ও শরীরেই কোপ ও লাঠির আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।’
গ্রেপ্তার অন্য ছয়জন হলো ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য বাচ্চু মিয়া, রবিউল আওয়াল, আতিকুর রহমান (৪২), মো. বায়েজ মাস্টার (৪৩), দুলাল (৪৫) ও আকাশ (২৪)। গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে চারটি মোবাইল ও একটি টর্চ লাইট উদ্ধার করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘মূলত একটি মোবাইল ফোন চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।’
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত