রাজশাহীর ইফতারে শাহী ফিরনি ও বাটার মোড়ের জিলাপি
যুগে যুগে দেশে কত কিছুর পরিবর্তন হলো। আধুনিকতার ভিড়ে পুরোনোদের স্থান এখন সংকীর্ণ। কিন্তু ব্যতিক্রম রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শাহি ফিরনি। রকমারি ইফতার পণ্যের সঙ্গে স্বমহিমায় আজও বিরাজমান সুস্বাদু এই খাবারটি। রাজশাহী মহানগরীর গণকপাড়া মোড়ের রহমানিয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁর এই ফিরনি বিক্রি হচ্ছে ১৯৫০ সাল থেকে।
বুধবার (৫ মার্চ) বিকেলে সরেজমিনে ৭৫ বছরের পুরোনো সেই রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চলছে ইফতার সামগ্রী তৈরির কাজ। অন্যসব ইফতার পণ্যের সঙ্গে ছোট ছোট মাটির পাত্রে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ফিরনি। প্রতি পাত্রে ফিরনি আছে ১০০ গ্রামের মতো, দাম ৩৫ টাকা।
নগরের উপশহর এলাকার বাসিন্দা রাজা মিয়া দুই পাত্র ফিরনি নিলেন। তিনি বলেন, আরও অনেক ইফতার কেনা হয়েছে। কিন্তু ইফতারে ফিরনির একটা আলাদা মূল্য আছে আমার কাছে। এখনকার অনেকেই হয়ত এই আইটেম কম পছন্দ করবে।
হোটেলের মালিক রিয়াজ আহাম্মেদ খান বলেন, ১৯৫০ সালের দিকে এই হোটেলের কার্যক্রম শুরু। তখন থেকেই তার দাদা আনিছুর রহমান খান এখানে শাহি ফিরনি বিক্রি শুরু করেন। দাদার মৃত্যুর পর তার বাবা আবদুল বারি খান ব্যবসার হাল ধরেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি এখন এ ব্যবসায় আছেন।
রিয়াজ আহাম্মেদ বলেন, এখন আর এটা ব্যবসা হিসেবে দেখি না। বাপ-দাদার শুরু করা ফিরনি এখনো চালু রেখেছি। কারণ, এটি এখন একটা ঐতিহ্য। রাজশাহীর বাইরে হোটেলটির পরিচিতি শুরু হয়েছিল এই ফিরনি দিয়ে। শুরুতে একবাটি ফিরনি চার আনায় বিক্রি হতো, এখন হচ্ছে ৩৫ টাকায়। এবার রমজানের প্রথম দিনে ৪০০ বাটি ফিরনি করা হয়েছিল, সব বিক্রি হয়ে গেছে। গত বছর দৈনিক এক হাজার বাটি ফিরনি বিক্রি করেছেন তারা।
রিয়াজ আহাম্মেদ খান বলেন, এটা ইফতারে সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার। গরুর খাঁটি দুধ এর প্রধান উপাদান। সঙ্গে থাকে চালের গুঁড়া, চিনি ও কিছু ফল।
এদিকে নগরের বাটার মোড়ে একটি দোকানে বিক্রি হয় মচমচে জিলাপি। দোকানটির কোনো নাম, সাইনবোর্ড নেই। ‘বাটার মোড়ের জিলাপি’ নামেই টিকে আছে। এটিও রহমানিয়ার মতোই পুরোনো দোকান। রমজানের সময় জিলাপি কিনতে এই মোড়ে বিকেল থেকেই ভিড় জমতে থাকে। সন্ধ্যার আগে এখানে লাইন ধরে জিলাপি কেনেন ক্রেতারা। সারা বছরই এই মোড়ে জিলাপি পাওয়া যায়। প্রতি কেজির দাম ২২০ টাকা।
এখান থেকে আধা কেজি জিলাপি কিনলেন নগরের গোরহাঙ্গার বাসিন্দা মফিজ উদ্দিন। তিনি বলেন, এখানকার জিলাপি স্বাদে একটু ভিন্ন। রমজান এলে মাসে অন্তত ১০-১২ দিন তিনি এখান থেকে জিলাপি কেনেন।
এই দোকানের মালিক ও কারিগররা বলেন, ১৯৫০ সালের দিকে এখানে জিলাপির ব্যবসা শুরু করেন সোয়েব উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি। তার একমাত্র কারিগর ছিলেন জামিলী সাহা। জামিলী সাহার সঙ্গে ১৯৭২ সাল থেকে কাজ শুরু করেন ছেলে কালীপদ সাহা। ১৯৮০ সালে জামিলী সাহা মারা গেলে কালীপদ সাহা হন প্রধান কারিগর। তিনি মারা যান ২০১৭ সালে। এরপর থেকেই জিলাপি তৈরি করছেন তার শিষ্য মো. সাফাত।
সোয়েব উদ্দিনের মৃত্যুর পর তার চার ছেলে জিলাপির দোকানটি পরিচালনা করছেন। তাদের একজন হাসিম উদ্দীন বলেন, এত বছর ধরে দোকানটির টিকে থাকার অন্যতম কারণ সততা। একেবারে ভালো মানের উপকরণ দিয়ে জিলাপি বানানো হয় এখানে। এ কারণে সারা বছরই বিক্রি হয়। রমজানে বিক্রি কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
দোকানের কারিগর মো. সাফাত জিলাপি ভাজতে ভাজতে বলছিলেন, ‘ওস্তাদ কালীবাবুর কাছ থেকে জিলাপি বানানো শিখেছি। উপকরণ, চিনি, ভাজার পরিমাণ ঠিকঠাক রাখতে হয়। তাহলেই জিলাপিতে একটি আলাদা রং আসে, মচমচে ও টসটসে হয়।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত