ঈদে আনন্দ ও সম্প্রীতির সম্মিলন
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে আসছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতরের অর্থ হচ্ছে রোজা ভাঙার উৎসব। তবে মুসলমানের আনন্দ-উৎসব আর অমুসলিমের আনন্দ-উৎসবে ভিন্নতা রয়েছে। মুমিনরা আনন্দ-উৎসব করে আল্লাহর পছন্দনীয় আমলের মাধ্যমে। কেননা মুসলমানের জীবন ও চিন্তা হয় আখিরাতকেন্দ্রিক। আসলে ঈদুল ফিতর আনন্দ ও ইবাদত দুটির সমন্বিত রূপ। এ আনন্দ আল্লাহর রহমত ও ক্ষমাপ্রাপ্তির, জাহান্নাম থেকে মুক্তির। এতে নেই কোনো অশ্লীলতা ও পাপ-পঙ্কিলতা। এ আনন্দে শুধুই সওয়াব ও পুণ্যময়তা। সংযুক্ত আছে ইবাদতের নিষ্ঠা ও কর্তব্যের তাগিদ। ধনীর সঙ্গে যেন দুঃখী ও দুস্থরা আনন্দে সমান অংশীদার হয়ে ওঠে, প্রতিষ্ঠিত হয় সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ। এজন্য ইসলাম ধনীদের ওপর ওয়াজিব করেছে সদকাতুল ফিতর। ঈদের জামাতে শরিক হওয়ার আগেই এ ফিতরা আদায়ের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। যাতে উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় সম্পদের সুষম বণ্টনের অনিবার্যতা। ফলে এ আনন্দ ছড়িয়ে যায় হৃদয় থেকে হৃদয়ে। শিশু-কিশোর থেকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার দেহমনে ঈদের ছোঁয়া লাগে। হতদরিদ্র, এতিম ও ছিন্নমূল মানুষের মুখেও হাসি ফোটে কিছু টাকা ও কিছু নতুন কাপড় পেয়ে।
ঈদের ফজিলত ও মর্যাদা: আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন ঈদুল ফিতরের দিন আসে, তখন আল্লাহ বান্দাদের বিষয়ে ফেরেশতাদের সঙ্গে গর্ব করে বলেন, হে আমার ফেরেশতারা! যে শ্রমিক তার কর্ম পূর্ণ করেছে, তার বিনিময় কী? তারা বলে, তাদের বিনিময় হলো তাদের পারিশ্রমিক পরিপূর্ণরূপে প্রদান করা। তিনি বলেন, হে আমার ফেরেশতারা! আমার বান্দা-বান্দিরা তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করেছে, তারপর দোয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়েছে। আমার সম্মান, করুণা, মাহাত্ম্য ও উচ্চমর্যাদার শপথ! আমি তাদের প্রার্থনা গ্রহণ করব।’ এরপর আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ফিরে যাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম এবং তোমাদের মন্দ আমলগুলো নেকিতে পরিবর্তন করে দিলাম।’ (বায়হাকি, খুতবাতুল আহকাম: পৃ. ১৬২-১৬৬)।
ঈদ প্রবর্তন হয় যেভাবে: নবীজি (সা.) মদিনায় পৌঁছে দেখতে পান, মদিনায় বসবাসকারী ইহুদিরা শরতের পূর্ণিমায় নওরোজ উৎসব এবং বসন্তের পূর্ণিমায় মেহেরজান উৎসব পালন করছে। তারা এ উৎসবে নানা আয়োজন, আচার-অনুষ্ঠান ও বিভিন্নভাবে আনন্দ উপভোগ করে থাকে। তাদের ভিত্তিহীন সংস্কৃতির মূলোৎপাটন করে শুদ্ধ সংস্কৃতি উদযাপনের নির্দেশনা দিয়ে রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রতিটি জাতির আনন্দ-উৎসব আছে। মহান আল্লাহ তোমাদের ওই উৎসবের বিনিময়ে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মতো পবিত্র দুটি দিন দান করেছেন। এতে তোমরা পবিত্রতার সঙ্গে উৎসব পালন করো।’ (বোখারি: ৯৫২)।
ঈদের নামাজের বিধান: ঈদের নামাজ পড়া পুরুষদের জন্য ওয়াজিব। ঈদের নামাজের সময় হলো সূর্যোদয়ের পর থেকে মধ্য দিবসের পূর্ব পর্যন্ত। ঈদের নামাজের আগে বা পরে কোনো নফল নামাজ পড়া যায় না। ঈদের নামাজের জন্য আজান-ইকামত দিতে হয় না। রমজানের ঈদ অপেক্ষা কোরবানি ঈদে জামাত একটু আগেই করা হয়; কারণ তারপরে কোরবানির পশু জবাইসহ নানান কাজ থাকে। রমজানের ঈদের নামাজের আগে এবং কোরবানির ঈদের নামাজের পর নাশতা খাওয়া সুন্নত।
ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়: ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। সর্বপ্রথম একে-অন্যকে সালাম দেবে। কেননা এর চেয়ে উত্তম আর কোনো অভিবাদন হতে পারে না। ইরশাদ হচ্ছে, সালামের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে মিল-মহব্বত বৃদ্ধি পায়, ইমানের পূর্ণতা লাভ হয় এবং জান্নাতে প্রবেশ করার পথ সুগম হয়। অতঃপর বলবে ঈদুন সাঈদুন অথবা ঈদুন মুবারকুন। (মুসলিম: ৫৪)
ঈদে নবীজির আমল: ঈদের দিনে সুন্দর পোশাক পরিধান করা, গোসল করা, ঈদগাহে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে বিজোড় খেজুর খাওয়া, হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া এবং যাওয়া-আসায় পথ পরিবর্তন করা, পথিমধ্যে তাকবির পড়া, ঈদগাহ থেকে ফিরে দুই রাকাত সালাত আদায় করা রাসুলের (সা.) সুন্নত। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা: ২/৩০)
বঞ্চিত মানুষের মাঝে ঈদ: ফুটপাতই যাদের আবাসস্থল, ঈদের দিনে আনন্দের বদলে তাদের চোখেমুখে থাকে অসহায়ত্বের ছাপ। অনেকে নতুন কাপড় পাওয়ার আশায় অপেক্ষার প্রহর গোনে। ভাসমান এসব মানুষের নির্দিষ্ট কোনো আশ্রয় থাকে না। আজ এখানে তো কাল ওখানে। ফুটপাতে মাথার ওপর কিছু প্লাস্টিক ও পলিথিন দিয়ে শামিয়ানা টানিয়ে কোনো রকমে আবাসের বন্দোবস্ত করে এমন পরিবারও এ শহরেই রয়েছে। একজন মানুষের থাকার জায়গা যেখানে হয় না সেখানে পুরো পরিবারকেই কষ্ট করে দিন পার করতে হচ্ছে। নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে মা বড় করছে আপন সন্তানকে। অনেকের বাবার সন্ধান নেই। বাবাকে চেনেও না। মা টুকটাক কাজ করে সন্তানের আহার জোগাড় করে। কোনো কোনো দিন অনাহারেও থাকতে হয়ে তাদের। ঈদ এলেই তাদের চেয়ে থাকতে হয় কারও সাহায্যের আশায়। সাহায্য মিললে হয়তো বছরে একদিন নতুন কাপড় পড়ার সৌভাগ্য হয় আর ভাগ্য খারাপ হলে সেটিও জোটে না।
আত্মীয়দের ঈদ-উপহার: নবীজি (সা.) বলেন, ‘সাধারণ দরিদ্র ব্যক্তিকে সদকা বা দান করলে কেবল সদকার সাওয়াব পাওয়া যায়। কিন্তু রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়কে সদকা বা দান করলে সদকাও হবে, আত্মীয়তাও রক্ষা হবে। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, তার দ্বিগুণ সওয়াব হবে। সদকার সওয়াব এবং আত্মীয়তা রক্ষা করার সওয়াব। সুতরাং আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট নয় বরং আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা উত্তম। ঈদ উপহার কিংবা জাকাত-সদকা দেওয়ার মাধ্যমে আপনজনদের সাহায্য-সহযোগিতা করা সুন্নতে নববীর একান্ত দাবি। এতে আত্মীয়দের সম্পর্ক জোরদার হয়। (বোখারি, মুসলিম)
ঈদের বার্তা ও আহ্বান: কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, এ অবস্থার অবসানকল্পে এবং গরিব, সর্বহারা ও অবহেলিত মানুষকে কাছে টেনে নেওয়ার প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণের দিন হচ্ছে ঈদুল ফিতর। আর এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জান্নাতি সুখের আমেজ। মহান আল্লাহ গরিব ও অসহায়দের সঙ্গে সঙ্গে নিজের আপনজনদেরও সাহায্য-সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে ইবাদতের মাধ্যমে সঠিকভাবে ঈদ উদযাপনের তওফিক দান করুন।
লেখক: ইমাম ও খতিব
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত