পিরিয়ড নিয়ে লজ্জা নয়, জ্ঞান থাকুক

| আপডেট :  ১৮ জুলাই ২০২৫, ০১:৫১  | প্রকাশিত :  ১৮ জুলাই ২০২৫, ০১:৫১

পিরিয়ড বা মাসিক একটি প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া, যা প্রতিটি কিশোরী ও নারীর জীবনের একটি অংশ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের সমাজে এখনও এটি নিয়ে অনেক লজ্জা, ভয় ও ভুল ধারণা ছড়িয়ে আছে।

অনেকেই খোলাখুলি কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন, যার কারণে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য তথ্য থেকে বঞ্চিত হন। অথচ এ জ্ঞান নারী-পুরুষ নির্বিশেষে থাকা প্রয়োজন। 

আজকের লেখায় আমরা সহজ ও পরিষ্কার ভাষায় জানবো পিরিয়ড কী, কেন হয়, এর ফলে একজন নারীর শরীরে কী পরিবর্তন আসে, এ সময়ে কী স্বাভাবিক আর কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। মাসিক নিয়ে লজ্জা না পেয়ে যদি আমরা সচেতন হই, তাহলে নিজের বা একজন নারীর শরীরকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবো, সুস্থ থাকতে বা রাখতে পারবো এবং ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য স্বাস্থ্যবান সমাজ গড়ে তুলতে পারবো।

চলুন আজ থেকেই পিরিয়ড নিয়ে ভুল ধারণা ভেঙে জ্ঞান ছড়াই।  

মাসিক/ পিরিয়ড (Menstruation) কী? 

মাসিক হলো নারীদের জরায়ুর ভেতরের আস্তরণ (lining) যা মাসে একবার ঝরে পড়া। এটিকে মেনস্ট্রুয়েশন, পিরিয়ড, মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল বা মেন্স নামেও ডাকা হয়। এই সময়ে জরায়ু থেকে রক্ত ও কিছু টিস্যু ভাজাইনার (yoni) মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে আসে।
 
এই প্রক্রিয়াটি শরীরের হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। হরমোন হলো এক ধরনের রাসায়নিক বার্তা বাহক। আমাদের মস্তিষ্কে থাকা পিটুইটারি গ্রন্থি এবং ডিম্বাশয় (ovary) থেকে নির্দিষ্ট সময়ে কিছু হরমোন নির্গত হয়।

এই হরমোনগুলোর কারণে জরায়ুর আস্তরণ মোটা হতে শুরু করে, যাতে গর্ভধারণ হলে সেই ভেতরের অংশে ভ্রূণ বসতে পারে। হরমোন ডিম্বাশয় থেকে একটি ডিম্বাণু বের করতেও সাহায্য করে (একেই বলে ওভুলেশন)। যদি ডিম্বাণুটি শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিত না হয়, তবে গর্ভধারণ হয় না। তখন জরায়ুর আস্তরণ ভেঙে পড়ে, আর সেটাই পিরিয়ড।

মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল কী?

মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল হলো মাসে মাসে শরীরে গর্ভধারণের জন্য যে প্রস্তুতি চলে, তার একটি পূর্ণ চক্র। এটা শুরু হয় মাসিক বা পিরিয়ডের প্রথম দিন থেকে এবং পরবর্তী মাসিকের আগের দিন পর্যন্ত চলে।

সাধারণত একটি মেনস্ট্রুয়াল সাইকেলের দৈর্ঘ্য কত?

গড়ে একটি চক্র ২৮ দিন হয়, তবে ২১ দিন থেকে ৩৫ দিন পর্যন্ত হলে তাও স্বাভাবিক ধরা হয়। 

পিরিয়ড ক’দিন থাকে?

বেশিরভাগ নারীদের পিরিয়ড ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত থাকে। 

৩ দিনের পিরিয়ড কি স্বাভাবিক?

হ্যাঁ, ৩ দিনের পিরিয়ড একেবারে স্বাভাবিক। সবার শরীর আলাদা, কারও কম দিন হয়, কারও একটু বেশি।

মেনস্ট্রুয়াল সাইকেলের ৪টি ধাপ কী কী?

মেন্সেস ধাপ (রক্তপাত): পিরিয়ড শুরু হয় এই ধাপে। যদি গর্ভধারণ না ঘটে, তাহলে জরায়ুর আস্তরণ ভেঙে পড়ে ও রক্ত বের হয়।
ফলিকুলার ধাপ: এই সময়ে হরমোনের কারণে জরায়ুর আস্তরণ আবার মোটা হতে থাকে, এবং ডিম্বাশয়ে একটি নতুন ডিম্বাণু তৈরি হয়।
ওভুলেশন ধাপ: সাধারণত চক্রের ১৪তম দিনে একটি ডিম্বাণু বের হয়।
লুটিয়াল ধাপ: ডিম্বাণুটি জরায়ুর দিকে যায়। গর্ভধারণ না হলে হরমোন কমে যায় ও পিরিয়ড আবার শুরু হয়।

সাধারণত মেয়েদের মাসিক কত বছর বয়সে শুরু হয়?

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গড়ে ১২ বছর বয়সে মেয়েদের মাসিক শুরু হয়। তবে মনে রাখতে হবে কারো কারো ক্ষেত্রে এটি ৮ বছরেও শুরু করতে পারে বা ১৬ বছরেও। শরীর, পরিবেশ, মানুসিকতার ওপর নির্ভর করে এর সময় ভিন্ন হত্যা পারে। 

মাসিক বন্ধ হয়ে যায় যখন মেনোপজ হয়, প্রায় ৫০-৫১ বছর বয়সে।

পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগের লক্ষণগুলো কী কী?

সব মেয়েদের এক রকম লক্ষণ থাকে না। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ নিচে তুলে ধরা হলো:

– পেট বা কোমরে ব্যথা (ক্র্যাম্প)
– মুড খারাপ বা রাগ-অবসাদ
– মাথাব্যথা
– বেশি খাওয়ার ইচ্ছে
– শরীর ফুলে যাওয়া (bloating)
– স্তনে ব্যথা
– ব্রণ ওঠা

সময়ের সঙ্গে পিরিয়ডে কী ধরনের পরিবর্তন হয়?

টিনএজে পিরিয়ড অনিয়মিত বা ভারী হতে পারে। ২০ বছর পেরিয়ে গেলে এটি সাধারণত নিয়মিত হয়। ৪০-এর পর আবার অনিয়মিত হতে পারে, যেটা মেনোপজের লক্ষণ। 

অনিয়মিত পিরিয়ড কাকে বলে?

অনিয়মিত পিরিয়ড তখনই বলা হয়, যখন মাসিকের সময় বা ধরন স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে চলে যায়। সবার মাসিক চক্র একরকম হয় না, তবে সাধারণত ২১ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে মাসিক হওয়াকে স্বাভাবিক ধরা হয়। যদি এই সময়ের বাইরে মাসিক হয়, অথবা রক্তপাত খুব বেশি বা খুব কম হয়, তবে সেটাকে অনিয়মিত পিরিয়ড বলা হয়। 

অনিয়মিত পিরিয়ডের কিছু লক্ষণ:

– ২১ দিনের কম বা ৩৫ দিনের বেশি ব্যবধানে পিরিয়ড হয়
– ৩ মাস পর্যন্ত পিরিয়ড না হয়
– অতিরিক্ত রক্তপাত হয়
– ৭ দিনের বেশি পিরিয়ড চলে
– মাঝপথে রক্তপাত হয়
– পিরিয়ডের সময় বমি, মাথা ঘোরা বা প্রচণ্ড ব্যথা হয়

পিরিয়ডে কতটুকু রক্তপাত স্বাভাবিক?

সাধারণতভাবে বোঝাতে হলে বলে যায় ঘণ্টায় ২-৩ টেবিল চামচ পরিমাণ রক্তপাত হয়। মনে রাখবেন, যদি প্রতি ঘণ্টায় প্যাড বা ট্যাম্পন বদলাতে হয়, বড় রক্ত জমাট পড়ে বা রক্তপাত টানা ৭ দিনের বেশি হয় তবে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা উচিত।

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি?

– ১৬ বছরেও পিরিয়ড না হলে
– ৩ মাস পর্যন্ত না হলে
– হঠাৎ বেশি বা কম রক্তপাত হলে
– প্রচণ্ড ব্যথা হলে
– পিরিয়ডের মাঝে রক্তপাত হলে
– গর্ভধারণ হয়েছে বলে সন্দেহ হলে

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের পরামর্শ

পিরিয়ড শুধু রক্তপাত নয়, এটা আপনার প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে অনেক কিছু বলে। যদি আপনার মাসিক ২১-৩৫ দিনের মাঝে হয় এবং ৩-৭ দিন পর্যন্ত থাকে, তাহলে সেটা স্বাভাবিক। তবে যেকোনো অনিয়ম বা উদ্বেগ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

সূত্র:  ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের ওয়েবসাইট

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত