রক্তাল্পতা ঝুঁকিতে আরও পৌনে ২ কোটি নারী

| আপডেট :  ০৪ ডিসেম্বর ০০০১, ১২:০০  | প্রকাশিত :  ০৪ ডিসেম্বর ০০০১, ১২:০০

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অন্যতম স্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা হলো রক্তাল্পতা, যে সমস্যায় সম্পৃক্ত এ অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক কিশোরী ও নারী। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বর্তমানে ২৫ কোটি ৯০ লাখের বেশি নারী ও কিশোরী এই স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, দ্রুত কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে আরও ১ কোটি ৮০ লাখ কিশোরী-নারী রক্তাল্পতাজনিত মারাত্মক জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্তাল্পতা একটি প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসাযোগ্য স্বাস্থ্য সমস্যা। অপ্রতুল পুষ্টি, আয়রনের ঘাটতি, সংক্রমণ, দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং গর্ভাবস্থা-সম্পর্কিত জটিলতা রক্তাল্পতার জন্য দায়ী। রক্তাল্পতা মোকাবিলা শুধু স্বাস্থ্যের বিষয় নয়, এটি নারী ও কিশোরীদের সুস্থতারও ভিত্তি। এটি স্বাস্থ্য বিনিয়োগের মতোই একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিনিয়োগ।

রক্তাল্পতা শুধু নারী ও কিশোরীদের প্রভাবিত করে না। এটি কম জন্ম ওজনের একটি প্রধান কারণ। বিশ্বে কম জন্ম ওজন নিয়ে ভূমিষ্ঠ শিশুদের ৪০ শতাংশেরই জন্ম দক্ষিণ এশিয়ায়। রক্তাল্পতা শিশুদের পর্যাপ্ত অক্সিজেন পাওয়ার ক্ষমতাকে ব্যাহত এবং তাদের বৃদ্ধি ও বিকাশকে প্রভাবিত করে। এর ফলে ক্লান্তি, বিলম্বিত শেখা এবং অসুস্থতার প্রতি সংবেদনশীলতা বাড়ে।

বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের সরকার রক্তাল্পতার বিরুদ্ধে সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে একত্রিত হয়েছে। গত ৯ থেকে ১১ জুলাই, দক্ষিণ এশিয়ান আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক), শ্রীলঙ্কা সরকার, ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং অন্যান্য অংশীদাররা শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে ‘পুষ্টিকর দক্ষিণ এশিয়া’ শীর্ষক সম্মেলনে মিলিত হয়। কিশোরী ও নারীদের রক্তাল্পতা হ্রাসে আয়োজন করা হয় এই আঞ্চলিক সম্মেলনের। এতে ১০০ জনেরও বেশি নীতিনির্ধারক, গবেষক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং উন্নয়নকর্মী একটি আঞ্চলিক কাঠামো ও দেশব্যাপী কর্মপরিকল্পনা গঠন করে, যা এই উপেক্ষিত স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সম্মেলনে একটি নতুন দক্ষিণ এশিয়া অ্যানিমিয়া একাডেমিক অ্যালায়েন্সও চালুর সিদ্ধান্ত হয়।

সম্মেলনে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ড. হরিণী অমরাসুরিয়া বলেন, ‘শ্রীলঙ্কায় রক্তাল্পতা এখনো একটি জনস্বাস্থ্য উদ্বেগের বিষয়, যেখানে প্রজনন বয়সের ১৮.৫ শতাংশ নারী এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৪.৬ শতাংশ কিশোরী অন্তর্ভুক্ত। আমরা আমাদের পুষ্টি কর্মসূচি জোরদার করছি, বিশেষ করে উচ্চহারের রক্তাল্পতাযুক্ত জেলাগুলোতে। সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশব্যাপী এ প্রচেষ্টাগুলো সম্প্রসারণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা ইউনিসেফ, ডব্লিউএইচও এবং জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে অংশীদারত্ব জোরদার করতে আগ্রহী।’

রক্তাল্পতা তখন ঘটে, যখন শরীরে অক্সিজেন বহন করার জন্য পর্যাপ্ত সুস্থ লোহিত রক্তকণিকার অভাব হয়। ফলে মানুষ দুর্বল, ক্লান্ত এবং অসুস্থতার জন্য বেশি সংবেদনশীল বোধ করে। কিশোরী এবং নারীর ক্ষেত্রে রক্তাল্পতা স্কুলে থাকা, কাজ করা বা পরিবারের যত্ন নেওয়া আরও কঠিন করে তোলে, বিশেষ করে অতিরিক্ত মাসিকের কারণে। পরিশেষে, গর্ভাবস্থায় রক্তাল্পতা মা এবং শিশু উভয়ের জন্যই ঝুঁকি তৈরি করে।

সার্কের মহাসচিব মো. গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের তরুণী এবং মায়েরা জনসংখ্যাগত ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সুস্থতা, পুষ্টি এবং ক্ষমতায়িত করা শুধু একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা নয়, এটি সমাজের ভবিষ্যতের জন্য একটি কৌশলগত বিনিয়োগ।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্তাল্পতা শুধু একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি দুর্বল পুষ্টি, সংক্রমণ এবং বৈষম্যের মতো গভীর সমস্যাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। যার প্রভাবে নারী এবং কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা দুর্বল স্বাস্থ্য, অপুষ্টি, হারানো সুযোগ এবং লিঙ্গবৈষম্যের বিদ্যমান সংকটকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

একটি অঞ্চলের অর্ধেক সংখ্যক কিশোরী ও নারীর রক্তাল্পতায় ভোগাকে উদ্বেগজনক বলে আখ্যায়িত করেন ইউনিসেফ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক মি. সঞ্জয় উইজেসেকেরা। তিনি বলেন, ‘যখন দক্ষিণ এশিয়ার অর্ধেক কিশোরী ও নারী রক্তাল্পতায় ভোগেন, তখন এটি শুধু একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, বরং এটি একটি সংকেতও, যে ব্যবস্থাগুলো তাদের ব্যর্থ করছে। আমরা জানি কী করতে হবে এবং আমরা জানি কীভাবে এটি করতে হবে। এখন সরকারগুলোর নেতৃত্ব দেওয়ার এবং সমাধানগুলো আরও বিস্তৃত করার সময়। যদিও অনেক দেশে রক্তাল্পতা মোকাবিলায় জাতীয় নীতিমালা রয়েছে, তবুও তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখনো উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যা অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। এর মধ্যে রয়েছে পরিষেবা প্রদানের জন্য অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো, বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়ের কাছে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের পৌঁছতে অসুবিধা এবং সীমিত কর্মসূচির সুযোগ, যা সব নারী ও কিশোরীর প্রান্তিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়।’

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত