বিশ্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রক এক পরিবার, ২০০ বছরের রহস্যময় গোপনীয়তা

| আপডেট :  ০৮ জুলাই ২০২৫, ০৯:১৬  | প্রকাশিত :  ০৮ জুলাই ২০২৫, ০৯:১৬

বিশ্বে এমন এক পরিবার আছে যাদের হাতের পুতুল হয়ে আছে ইউরোপ-আমেরিকার বাঘা বাঘা সব বিশ্বনেতা। বলা হয় গত শতাব্দীর যুদ্ধ-সংঘাত কিংবা শান্তির পেছনে অদৃশ্য ছায়ার মতো কলকাঠি নেড়েছে পরিবারটি। আর এর সবকিছুই তারা ঘটিয়েছে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য।

প্রভাবশালী ওই পরিবারের এক ইশারায় তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ত বিভিন্ন দেশের সরকারও। এই পরিবারেরই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিশ্বের অর্থনীতি, খনিজ তেল, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, এমনকি প্রযুক্তি ও ফার্মাসিউটিক্যাল জগতের বহু জায়ান্ট। তবে বিশ্বের অন্যতম ধনাঢ্য পরিবার হওয়ার পাশাপাশি সবচেয়ে রহস্যময় পরিবারের তকমাও জুটেছে তাদের।

এই পরিবারের সদস্যদের খুব কমই দেখা যায় জনসমক্ষে। মিডিয়ায় নেই তেমন উপস্থিতি, নেই রাজনৈতিক দৃশ্যমান ভূমিকা। তবু তারাই যেন বিশ্বরাজনীতির এক নীরব পরিচালক!  

বিশ্বব্যাপী এই অর্থ সাম্রাজ্যের সূচনা করেন মায়ার আমসেল রথসচাইল্ড। যার নামেই আজকের আলোচিত রথসচাইল্ড পরিবার। ১৭৪৪ সালে জার্মানির এক ইহুদি পরিবারে জন্ম মায়ার। বাবা ছিলেন পেশায় একজন মহাজন ও সিল্কের ব্যবসায়ী। মাত্র ১২ বছর বয়সেই বাবা-মাকে হারিয়ে ছোট্ট মায়ার জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন।

নিঃস্ব বালক বাধ্য হয়ে পাড়ি জমান হ্যানোভার শহরে, যেখানে এক খ্যাতনামা ব্যাংকে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানেই আর্থিক ব্যবস্থার জটিল কাঠামো, সুদের খেলা ও বিনিয়োগের কৌশল শেখেন। এই এক বছরের শিক্ষা ছিল মায়ারের হাত ধরে বিশ্বের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। অভিজ্ঞতা অর্জনের পর আবার ফিরে আসেন নিজ জন্মস্থান ফ্রাঙ্কফুর্টে। ইহুদি মহল্লাতেই খুলে বসেন ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ছোট্ট ব্যাংক। 

যুবক মেয়ার একদিকে যেমন ছিলেন সুদর্শন। তেমনই ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, সপ্রতিভ আচরণ ও অপূর্ব ব্যক্তিত্বের অধিকারী। খুব অল্পতেই অচেনা মানুষকে মুগ্ধ করে ফেলতেন। এই গুণগুলোই ছিল তার ব্যবসার বড় হাতিয়ার। ধীরে ধীরে তিনি সমাজের ধনী, সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী মানুষদের নিজের ব্যাংকের গ্রাহক বানিয়ে ফেলেন। সেই সূত্র ধরেই রাজা উইলিয়াম হয়ে উঠেছিলেন মেয়ারের বন্ধু। রাজপরিবারের অগোচরে পড়ে থাকা প্রাচীন শিল্পকর্ম ও মূল্যবানসামগ্রী তিনি সংগ্রহ করতেন সস্তা দামে যা তিনি ইউরোপজুড়ে বিক্রি করতেন উচ্চমূল্যে। এতে করে কেবল তার পুঁজিই বাড়েনি, তৈরি হয় সাংস্কৃতিক-আর্থিক প্রভাবের এক নতুন বলয়। ফলে ক্রমশ ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করে ধুরন্ধর এই ইহুদির ব্যবসা। 

যখন ইউরোপজুড়ে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা, ঠিক তখনই ভাগ্য খুলে যায় মেয়ারের। নেপোলিয়নের ফ্রান্স একে একে আক্রমণ চালায় ব্রিটেন ও তার মিত্রদেশগুলোর ওপর। নেপোলিয়নের আগ্রসন থেকে বাঁচতে রাজা উইলিয়াম পালিয়ে যাওয়ার আগে তার বিশাল পরিমাণ অর্থ সম্পদ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বন্ধু মেয়ারের কাছে। তিনি এই সুযোগ কাজে লাগাতে ভুল করেননি। চতুর মেয়ার কৌশলে সেই অর্থকে পুঁজি করে নিজের চার ছেলেকে পাঠিয়ে দেন ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ চার শহর—লন্ডন, প্যারিস, নাপলস ও ভিয়েনায়। তাদের দায়িত্ব দেন সেখানে মার্চেন্ট ব্যাংক খুলতে। আর আরেক ছেলেকে নিজের কাছে রেখে দেন ফ্রাঙ্কফুর্টের ব্যবসা সামলাতে। 

রথসচাইল্ড পরিবারের সবচেয়ে চতুর ছিলেন নাথান। লন্ডনে বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছিল তার ব্যবসা। এন এম রথসচাইল্ড অ্যান্ড সনস লিমিটেড নামে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ১৮১১ সালে ইংল্যান্ড-নেপোলিয়ন যুদ্ধের সময় নাথান দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি প্রকাশ্যে ইংরেজ সরকারকে অর্থায়ন করতেন, আবার গোপনে নেপোলিয়নের কাছেও  টাকা পাঠাতেন। দুপক্ষকেই আর্থিকভাবে বশে রেখেছিলেন। যেখানে যুদ্ধ করত রাজারা, আর মুনাফা কামাতো রথসচাইল্ডরা। 

এরপর ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারকে চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়া শুরু করেছিলেন নাথান ও তার চার ভাই। রাজপ্রাসাদে প্রজাবিদ্রোহের আতঙ্কে, শাসকেরা নিজেদের সম্পদ নিরাপদ রাখতে রথসচাইল্ডদের ব্যাংকে অর্থ জমা করতে থাকেন। ধীরে ধীরে ইউরোপের খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি সম্পূর্ণ নিজের মুঠোয় নিয়ে নেয় রথসচাইল্ড পরিবার। 
এখান থেকেই  রথসচাইল্ড পরিবার পা বাড়িয়েছিল আমেরিকার দিকেও। তবে মার্কিন সরকারের কাছে সুবিধা করতে না পেরে অন্তরে জ্বালা ধরে নাথানের। তাই শাস্তি হিসেবে ১৮১২ সালের ব্রিটেন-আমেরিকার যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। যুদ্ধশেষে বিধ্বস্ত আমেরিকার অর্থনীতি চাঙ্গা করতে ১৮১৬ সালে গঠিত হয় আমেরিকার সেন্ট্রাল ব্যাংক, যার প্রধান বিনিয়োগকারী ছিলেন নাথান। এখানেই শেষ নয় ১৯০৪-০৫ সালের রাশিয়া-জাপান যুদ্ধেও রথসচাইল্ড পরিবার বিপুল অঙ্কের ঋণ দেয় জাপানকে। যুদ্ধবন্ড বিক্রি করে রাতারাতি কামিয়ে নেয় কোটি কোটি ডলার। এ যেন যুদ্ধ থেকে সম্পদ বানানোর নিখুঁত ব্যবসা। 

রথসচাইল্ড পরিবারের জন্য যুদ্ধ ছিল শুধুই লাভজনক ব্যবসা। তারা একযোগে দুপক্ষকে যুদ্ধের রসদ কিনতে অর্থ দিত চড়া সুদে। আবার যুদ্ধ শেষ হলে, বিধ্বস্ত রাষ্ট্রগুলোকে পুনর্গঠনের জন্য দিত নতুন ঋণ। যাকে বলে এক হাতে আগুন ধরিয়ে, অন্য হাতে পানি দেওয়া। এই কৌশলে দুই দিক থেকেই বিপুল মুনাফা কামাত রথসচাইল্ড পরিবার। এককথায়, যুদ্ধই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় পুঁজি। 

এন এম রথসচাইন্ড অ্যান্ড সন্স’ ব্যবসা শুরু করার পর কেটে গেছে ২০০ বছর। ব্যাকিং ব্যবসা ছাড়াও, রিয়েল এস্টেট, সোনা, হীরা, জাহাজ, খনি, হোটেলসহ কয়েকশ’ ব্যবসা আজও রথসচাইল্ড পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। তবুও রহস্যময় কারণে সমাজ থেকে স্বেচ্ছায় নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে পরিবারটি। সমাজসেবামূলক অনুষ্ঠান ছাড়া ক্যামেরার সামনে খুব কমই দেখা যায় এই পরিবারের সদস্যদের।

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত