সমু চৌধুরী: এক নির্মম সৌন্দর্য ও বিস্মৃত বিস্ময়
সালটা ছিল ২০০৮। আমার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ঊনাদিত্য – Less Than Sun God সদ্য শেষ করেছি। জীবন তখন তীব্র অনিশ্চয়তায় মোড়া – শিল্প, জীবন, ব্যক্তিগত যাত্রাপথ সবকিছু একরকম দোলাচলে। এমন একসময়ে আমার দেখা হয়, কাজ হয় এক ব্যতিক্রমী মানুষের সঙ্গে সমু চৌধুরী। তিনি অভিনেতা, কবি, পথিক—তবুও এগুলো কোনো পরিচয় নয়। তিনি যেন এক নামহীন, রক্তাক্ত ক্ষত, যাকে শিল্পের নামে জন্ম দেওয়া হয়েছে, অথচ সমাজ তাকে উপেক্ষার নিঃসঙ্গ ঘরে ঠেলে দিয়েছে।
ঊনাদিত্য ছবির জন্য আমি খুঁজছিলাম এমন একজনকে—যার ভেতরে জ্বলছে এক অনির্বাণ আগুন। ক্যামেরার সামনে সমু-দাকে বসানোর পর মুহূর্তেই বুঝলাম—এই মানুষটিকে ক্যামেরা ভালোবেসে ফেলবে। কিন্তু শুধু ভালোবাসা নয়—এই মানুষটিকে ক্যামেরা ক্ষমাও করবে না। কারণ তার চোখে ছিল ইতিহাস, তার নীরবতায় ছিল হাজার অনুচ্চারিত কবিতা, আর তার শরীরে ছিল এক অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদ—যা আমাদের তথাকথিত সাংস্কৃতিক নায়কদের অনেক ওপরে।
আমরা শুটিং করেছি গ্রামে, ধুলায়, গরমে। সমুদা একবারও অভিযোগ করেননি। অস্বস্তিকে তিনি রূপ দিয়েছেন গভীরতায়। চরিত্রটি ছিল একজন ওরাও সম্প্রদায়ের শিক্ষিত পুরুষ যিনি কিনা চার্চের পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষিত হয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে তারই নিজ গ্রামে ব্রাদার হয়ে চার্চের দ্বায়িত্ব নিয়ে বদলে ফেলতে চেয়েছিলো পুরো ওরাও সম্প্রদায়কে। আর এ নিয়েই তৈরি হয়েছিল দ্বন্দ্ব ওরাও আর চার্চের! ধর্ম বড় নাকি গোত্র বড় এই প্রশ্ন করতে করতেই সমু চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন সেই ব্রাদার যার জীবনে ক্যামেস্ট্রি নিয়ে পড়ার পরও সে মানবিক ক্যামেস্ট্রিতে দুর্বল ছিলেন। চরিত্রটিকে ধারন করতে সমু চৌধুরীর কোনো বেগ পেতে হয়নি। আমি শুধু ক্যামেরার পেছন থেকে দেখলাম একজন শিল্পীর আত্মিক মুক্তি। আমরা শুটিং করেছি, কিন্তু সমুদার শব্দে চরিত্র অনুভব করেছি হৃদয়ে।
আজ যখন দেখি সেই শিল্পী ফুটপাতে, নামমাত্র কাপড়ে মোড়া, গাছের নিচে ঘুমিয়ে আছেন অচেতনে—আমি এক শিল্পীর নীরব প্রতিবাদ শুনতে পাই। সমু চৌধুরী কখনও শুধুমাত্র একজন অভিনেতা ছিলেন না। তিনি এক জীবন্ত নাট্যমঞ্চ, এক রাজনৈতিক বর্ণনা, এক শিল্পিত বেদনাকে রূপ দেওয়া দেহ। আমাদের সমাজ তাকে সম্মান দিতে পারেনি। আমাদের চলচ্চিত্রজগৎ তাকে ধারণ করতে পারেনি। তবুও, তিনি আমাদের সবটুকু দিয়ে গেছেন।
আমরা যারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করি, আমরা জানি একজন অভিনেতা সম্পূর্ণভাবে নিজেকে কিভাবে ক্যামেরার হাতে সঁপে দেন। সমুদা তা-ই করেছিলেন। তিনি দিয়েছেন তার দারিদ্র্য, তার নিঃসঙ্গতা, তার স্বপ্ন, তার ক্ষুধা, তার আগুন—সবকিছু। তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন এক আহত দৈত্যের মতো, এক ভাঙা পুরাণের মতো, যে এখনো সাহস করে সত্য বলে।
উনাদিত্য হয়তো গোয়ার সাউথ এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়েছিল, কিন্তু আমার কাছে এর আসল মূল্য এই যে সমু চৌধুরী ছিলেন এ ছবির হৃদস্পন্দন। কোনো উৎসব সম্মান বা পুরস্কার তার এই অবদানকে ছুঁতে পারে না।
আমি গর্বিত যে তার সঙ্গে কাজ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু একইসাথে লজ্জিত যে আমরা, এই সমাজ, তাকে রক্ষা করতে পারিনি।
সমু চৌধুরী আজও জীবিত—আমাদের স্মৃতিতে, আমাদের রিলের দৃশ্যপটে, থিয়েটারের প্রেতাত্মা আলোয়, রাস্তার দেয়ালে আঁকা তার প্রতিচ্ছবিতে। সর্বোপরি, তিনি জীবিত আমাদের দায়িত্ববোধে শিল্পী হিসেবে, নাগরিক হিসেবে, মানুষ হিসেবে।
একজন শিল্পী যদি সমাজের আয়না হন, সমু চৌধুরী সেই ভাঙা কাচ—যার ভেতর দিয়ে আমরা আমাদের রক্তাক্ত প্রতিবিম্ব দেখতে পাই।
লেখক: রাজীবুল হোসেন, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিক্ষাবিদ
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত