সমাবেশ নিয়ে কথা রেখেছে ছাত্রদল
ধীরে ধীরে নিজেদের সাংগঠনিকভাবে পুনর্গঠনের পথে হাঁটছে বাংলাদেশের অন্যতম ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দীর্ঘ সময়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জ ও অন্তর্দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত ছিল সংগঠনটি। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শাসনের পতনের পর রোববার (৩ আগস্ট) রাজধানীর শাহবাগে বড় ছাত্র সমাবেশ করেছে ছাত্রদল। যা ছিল বেশ আলোচিত।
দলীয় ব্যানারে হলেও পুরো আয়োজনটি ছিল শৃঙ্খলাপূর্ণ, সহিংসতামুক্ত ও গঠনমূলক বক্তব্যে সমৃদ্ধ। কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করেন নেতারা। তাছাড়া কর্মদিবসের দিন সমাবেশ করায় জনসাধারণের কিছুটা কষ্ট হবে উপলব্ধি করে আগাম দুঃখ প্রকাশ করেছে ছাত্রদল। বিশেষ করে পূর্ব নির্দেশনা মোতাবেক কোনো ধরনের ব্যানার-ফ্যাস্টুন ছাড়াই সমাবেশে যোগ দেন ছাত্রদলের হাজারো নেতকর্মী।
সমাবেশে ২৪ এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্রজনতার প্রত্যাশা পূরণে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ৯ দফা প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হয়। ছাত্রদলের সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ছাত্ররাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি ইতিবাচক নজির স্থাপন করেছে। যা সাধারণ মানুষের মাঝে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দেয়। অনেকেই সমাবেশটিকে ছাত্রদলের জন্য একটি পজিটিভ টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখছেন।
এদিকে ছাত্রদলের বড় এই আয়োজনকে কেন্দ্র করে সংগঠনটির ভাবমূর্তি যেমন নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে, তেমনি রাজনীতিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তাও ফের সামনে এসেছে।
ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এবং জুলাই আন্দোলনের হটস্পট শাহবাগ চত্বরে রোববারের ছাত্রসমাবেশে অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, তিতুমীর কলেজসহ ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদলের অসংখ্য নেতাকর্মী। শাহবাগ চত্বর এবং তার দুই পাশে সড়ক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সড়কে নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে সমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। আগতদের কারও কারও পরনে ছিল রং-বেরংয়ের গেঞ্জি ও ক্যাপ। তবে ঢাকার বাইরে থেকে আসা কিছু সংখ্যক নেতাকর্মী হাতেগোনা কয়েকটি ব্যানার-পোস্টার বহন করেছেন সমাবেশে। যাতে লেখা ছিল গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি। তবে সমাবেশ শেষে ছাত্রদল নেতাকর্মীরা নিজেই শাহবাগ ও আশপাশের এলাকা পরিষ্কার করেন। অর্থাৎ সমাবেশস্থল পরিস্কারের মাধ্যমে ছাত্রদল তাদের পূর্বঘোষিত ওয়াদা রেখেছে বলে সংগঠনটির দায়িত্বশীল নেতারা জানান।
উল্লেখ্য, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূতি উপলক্ষ্যে আয়োজিত সমাবেশে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবু্ল ইসলাম রাকিবের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাক নাছির উদ্দীন নাছিরের সঞ্চালনায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, আসাদুজ্জামান রিপন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি আবু আফসান মো. ইয়াহিয়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল মালুম ও সাংগঠনিক সম্পাদক আমানউল্লাহ আমান বক্তব্য দেন।
অন্যদের মধ্যে ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা নাজিম উদ্দিন আলম, কামরুজ্জামান রতন, এবিএম মোশাররফ হোসেন, আজিজুল বারী হেলাল, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, আমিরুল ইসলাম খান আলিম, আবদুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েল, হাবিবুর রশীদ হাবিব, আকরামুল হাসান, ফজলুর রহমান খোকন, ইকবাল হোসেন শ্যামল, কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, সাইফ মাহমুদ জুয়েল ও রাশেদ ইকবাল খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাছির রোববার সমাবেশ সফল হওয়া প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, আমরা মূলত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর উপলক্ষ্যে একটি ছাত্রসমাবেশের আয়োজন করেছি। যেখানে আমাদের সাংগঠনিক অভিভাবক তারেক রহমান প্রধান অতিথির বক্তব্যে দেশের ছাত্রসমাজকে আদর্শ নাগরিক ও দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন।
নাছির উদ্দিন বলেন, ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস গৌরবময়। আমরা সেই ঐতিহ্য ফিরে পেতে চাই। সহিংসতা নয়, যুক্তি ও আদর্শের মাধ্যমে আমরা আমাদের অবস্থান তুলে ধরতে চাই। শিক্ষাঙ্গনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং নিরাপদ ক্যাম্পাসই হবে ছাত্রদলের ভবিষ্যৎ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে দেশের ১৮০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা মোতাবেক সামনের দিনে কর্মসূচি নিয়ে কাজ করতে চাই।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. তরিকুল ইসলাম তারিক কালবেলাকে বলেন, বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা ছড়িয়ে দিতে এবং শিক্ষাঙ্গনে সহাবস্থান ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় তারা আবারও সংগঠিত হচ্ছেন। আমরা সংঘাত নয়, মতপ্রকাশের অধিকার চাই। ছাত্ররাজনীতিকে স্বচ্ছ ও আদর্শভিত্তিক করতে আমরা নতুন পথে হাঁটছি।
এদিকে ছাত্রদলের সমাবেশ নিয়ে নেট দুনিয়ায় বেশ সাড়া ফেলেছে। সুশৃঙ্খলা সমাবেশ নিয়ে অনেকেই ইতিবাচক পোস্ট ও মন্তব্য শেয়ার করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে ছাত্রদলের এই নতুন ধরন প্রশংসা পাচ্ছে।
অনেকেই মন্তব্য করেছেন, “এটাই হওয়া উচিত রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রকৃত রূপ—গণতান্ত্রিক, সুশৃঙ্খল, এবং স্বতঃস্ফূর্ত।”
ছাত্রসমাবেশে কাছ থেকে অবলোকন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের চেয়ারম্যান ইস্রাফিল প্রামাণিত রতন। তিনি কালবেলাকে বলেন, সহিংসতার বদলে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মত প্রকাশ ছাত্ররাজনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, শাহবাগে সুশৃঙ্খল সমাবেশ ছাত্রদলের জন্য যেমন একটি পুনর্জাগরণের ইঙ্গিত, তেমনি দেশের ছাত্ররাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রার সূচনা হতে পারে। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তবে ছাত্রদল আবারও শিক্ষাঙ্গনে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে—তবে এবার ভিন্ন এক ইতিবাচক রূপে।
ছাত্রদলের সাবেক নেতা ও পেশাজীবী প্রকৌশলী মো. আমিনুর ইসলামও ছাত্রদলের সমাবেশ কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি বলেন, শাহবাগে ছাত্রদলের বিরাট সমাবেশ নিঃসন্দেহে তাদের পুনর্জাগরণের একটি বড় পদক্ষেপ। ছাত্রদল যদি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শকে ধারণ করে ও ছাত্রসমাজের প্রত্যাশাকে অগ্রাধিকার দেয় এবং শিক্ষার্থীদের প্রকৃত প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারে-তবে তারা আগামী দিনে দেশের ছাত্ররাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সুস্থতা নিশ্চিত করতে এমন গঠনমূলক এবং সুশৃঙ্খল রাজনীতি অনুকরণীয় হয়ে উঠবে, এটাই এখন সকলের প্রত্যাশা।
ছাত্রদলের সহসভাপতি মো. আনোয়ার পারভেজ কালবেলাকে বলেন, তারা এখন থেকে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণসংযোগ, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা নিয়েছেন। লক্ষ্য হচ্ছে সংগঠনকে শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তরুণদের সম্পৃক্ত করা।
জানা গেছে, সমাবেশ উপলক্ষ্যে আগেই নেতাকর্মীদের ৬ দফা নির্দেশনা দেয় ছাত্রদল। সেগুলো হচ্ছে- ১. ছাত্র সমাবেশে কোনো ধরণের ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড নিয়ে আসা যাবে না। ২. সমাবেশের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত জায়গায় সকল ইউনিটকে বাধ্যতামূলকভাবে অবস্থান করতে হবে। ৩. কাঁটাবন মোড় থেকে আজিজ সুপার মার্কেট ও পিজি হসপিটালের মাঝের গলি দিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল পর্যন্ত এ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি সেবায় নিয়োজিত যানবাহনের চলাচলে সার্বিক সহযোগিতা করা। ৪. ছাত্রদলের কোনো ইউনিটের গাড়ি কোনো অবস্থাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ৫. ব্যক্তিগত শোডাউন ও মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসা যাবে না। এবং ৬. সংশ্লিষ্ট ইউনিটের জন্য নির্ধারিত স্থান পরিষ্কার করে সমাবেশস্থল ত্যাগ করতে হবে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত