বৈশ্বিক মঞ্চের নতুন খেলোয়াড় আফগানিস্তান, কাছে টানতে মরিয়া পরাশক্তিগুলো

| আপডেট :  ০১ আগস্ট ২০২৫, ০৯:২৫  | প্রকাশিত :  ০১ আগস্ট ২০২৫, ০৯:২৫

আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক ও বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ শুরু হয়েছে। দেশটিকে কাছে টানার চেষ্টা করছে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি চীন, ইরান, ভারত এবং পাকিস্তান। তবে এই দৌড়ে সবার চেয়ে এগিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। 

ঐতিহাসিকভাবে আফগানিস্তানের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে এই দেশগুলোর অধিকাংশের সম্পর্ক একসময় উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। রাশিয়া ব্যতীত জাতিসংঘ বা সংস্থাটির কোনো সদস্য রাষ্ট্রই আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আফগানিস্তানের কূটনৈতিক তৎপরতা প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের চাপের মুখেও বৈশ্বিক মঞ্চে তারা সম্পূর্ণভাবে একঘরে হয়ে যায়নি।

বিশেষ করে আফগানিস্তানের প্রতিবেশী একাধিক দেশ কাবুলের বর্তমান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিয়েও কূটনৈতিকভাবে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে। 

প্রথমে আসা যাক ভারতের কথায়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্থানের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের প্রথম শাসনামলে ভারত সরকার আফগান গোষ্ঠীটির সঙ্গে কোনো যোগাযোগে যায়নি এবং তাদের শাসনকে স্বীকৃতি দেয়নি। তখন শুধু পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব তাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল।

ওই সময় ভারত আফগানিস্তানে সোভিয়েত-সমর্থিত মোহাম্মদ নজিবুল্লাহ সরকারের পক্ষ নিয়েছিল। কাবুলে নিজেদের দূতাবাস বন্ধ করে দিয়েছিল। ভারত আফগান গোষ্ঠীকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি প্রক্সি বাহিনী হিসেবে দেখেছিল। তখন আফগানিস্তানে মস্কোবিরোধী গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়েছিল পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের তৎকালিন সরকার অপসারিত হওয়ার পর ভারত কাবুলে আবারও দূতাবাস চালু করে ও আফগানিস্তানের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদারে পরিণত হয়। ভারত আফগানিস্তানের অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পানি সরবরাহ প্রকল্পে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে।

কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো সমর্থিত দুর্নীতিবাজ আশরাফ গনি সরকারকে হটিয়ে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসে আফগানিস্তানের বর্তমান গোষ্ঠী। এবারও ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। তবে দেশটি তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু করেছে। প্রথমে এই যোগাযোগ পর্দার অন্তরালে হলেও ক্রমেই তা প্রকাশ্য হতে শুরু করে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার ভারত বুঝতে পেরেছে যে, আগের মতো আফগানিস্তানকে এড়িয়ে চলার অর্থ হবে, প্রতিবেশী আফগানিস্তানের ওপর তার প্রভাব রাখার সুযোগকে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের কাছে ছেড়ে দেওয়া।

পাকিস্তান ১৯৯৬ থেকে ২০২১ সালে আফগানিস্তানের তৎকালীন সরকারের প্রধান সমর্থক ছিল পাকিস্তান। বর্তমান সরকারের সঙ্গেও দেশটি সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯ এপ্রিল পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল নিয়ে কাবুলে আফগান কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, উভয় পক্ষ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এরপর ৬ মে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এটি ছিল পাকিস্তানে ভারতের হামলার ঠিক আগের দিন। এরপর দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে চার দিন ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের হামলা, পাল্টাহামলা চলে। কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান সংকট চলাকালে আফগানিস্তান ভারতকে নিজেদের ভূখণ্ড ব্যবহারের কোনো সুযোগ দেয়নি। 

এবার আসা যাক ইরানের কথায়। আফগানের বর্তমান ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর তেহরানও তাদের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৯৮ সালে মাজার-ই-শরিফে আফগান যোদ্ধাদের হাতে কয়েকজন ইরানি কূটনীতিক নিহত হওয়ার পর ইরান তার পূর্ব সীমান্তে হাজার হাজার সেনা জড়ো করেছিল এবং কাবুলের সঙ্গে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল।

তবে ৯/১১ পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন ইরান নীরবে আফগানিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলা ও নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করার জন্য আফগানিস্তানকে সীমিত সহায়তাও দেয়।

এরপর ২০২১ সালে আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইরান কাবুলের সঙ্গে নিরাপত্তা, মানবিক সহায়তা ও বাণিজ্যসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে সম্পর্ক গড়ে তুলে।

এই অবস্থায় গেল ২১ মে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীন সফর করেন। ওই সময় আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকের লক্ষ্য ছিল, তিন দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।

এই দৌড়ে সবার চেয়ে এগিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পুশ্চিমাদের চোখ রাঙানো উপেক্ষা করে  ৩ জুলাই আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারকে স্বীকৃতি দেয় রাশিয়া।  ২০২১ সালে সরকার গঠন করার পর এই প্রথম স্বীকৃতি পেল আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার। তাও যেনতেন কোনো দেশ নয়, রাশিয়ার মতো প্রভাবশালী দেশের স্বীকৃতি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে বলয় শক্ত করা, নিজেদের নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক কারণে পুতিন এই কূটনীতি গ্রহণ করেছেন।

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত